Tanvir Masud

শব্দের দৃষ্টান্তবাদী ব্যাখ্যা
তানভীর মাসুদ

কবিতা হচ্ছে অর্থপূর্ণ শব্দসহযোগে তাৰপর্যপূর্ণ বাক্যের মাধ্যেমে সৃষ্ট অভিঘাত, যা পাঠককে কিছুটা হলেও পুলকিত অথবা পরিস্রুত কিংবা মুগ্ধ করে। যার দৃষ্টান্ত রয়েছে তাই তো অর্থপূর্ণ এবং তার সহযোগেই রচিত হতে পারে তাৰপর্যপূর্ণ বাক্য। এ-যে বক্তব্য, এর অপ্রত্যক্ষ উল্লেখ রয়েছে চার্বাক দর্শেন। চার্বাকরা অধ্যাত্মবাদী মতের বিরোধিতা করতে গিয়ে এ-জাতীয় বক্তব্য পেশ করেছেন। অধ্যাত্মবাদীরা বলেন, বস্তুকে নিয়ে কৃত শব্দই বস্তুর অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। এ-হিসেবে অদৃশ্য বস্তুকে চিহ্নিত করতে আমরা যে-শব্দ ব্যবহার করি, তা তার অস্তিত্বের প্রমাণ। এ-কথার বিরোধিতা করে চার্বাকরা বলেন, অদৃশ্য বস্তুকে আমরা যে-শব্দে উপস্থাপন করি, তা তার প্রমাণ হতে পারে না। এটাকে প্রমাণ বলা যেতে পারে। অনুমান প্রমাণ নয়, এ-হিসাবে অনুমান-নির্ভর শব্দ বা বাক্য বস্তুর অস্তিত্বের যথার্থ প্রমাণ হতে পারে না। তাই অনুমান-নির্ভর নয়, প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে আমরা যে-শব্দ ব্যবহার করি, অর্থপূর্ণ এবং এ-জাতীয় অর্থপূর্ণ শব্দের সমবায়েই নির্মিত হতে পারে তাৰপর্যপূর্ণ বাক্য। দৃষ্টান্তবাদ অনুসারে, কবিতা হচ্ছে কবিমনের অনুভব, যার মধ্যে থাকছে বাস্তব অভিজ্ঞতার ছবি। পাঠকের মনে তখনই কবির অনুভবের সম্প্রসারণ ঘটে, যখন কবিদৃষ্টিকে পাঠক আপন অন্তর্দৃষ্টি মনে করেন। কবিতা তখনই স্থায়ী এবং সঞ্চারী হবে, যখন কবির চয়িত ছবি, অভিজ্ঞতার খণ্ডাংশ, ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুৱখ-আনন্দানুভূতি পাঠককে বিমুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
দৃষ্টান্তবাদ কবিতাস্থ সৌন্দর্য উপভোগের বেলায় অদৃশ্য বা অস্পৃশ্য সত্তা এবং যুক্তিরহিত বিষয় প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৰ এ-মতবাদ দাবি করে, কবিতার দেহ হবে বাস্তবতাঘনিষ্ঠ-সমার্থক শব্দ বা নামের সহযোগেই। সবুজ তাপস বলেন, সৌন্দর্যোপভোগ কেবল জ্ঞানেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সক্রিয়তার মাধ্যমেই সম্ভব। এ-কথা বলে তিনি সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও মলয়রায় চৌধুরীর মতোন পণ্ডিতদের সমালোচনা করেছেন। তারা সৌন্দর্য-এর সমার্থক শব্দ তুলে ধরার সময় ধর্মবিশ্বাসযুক্ত-লিঙ্গভেদসমর্থিত শব্দকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, নন্দন-এর সাথে নন্দনকানন-এর সম্পর্ক খুজে কবিতার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। বিশ্বাসী মানুষ এমনই করেন- সুন্দর সুন্দর শব্দকে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ঢুকিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তি পেতে চান। তার মতে, এভাবেই বোধ হয় হিন্দুমৌলভি কিংবা মতলবিরা কৃষ্ঞ-এর আগে, হিন্দুনামের আগে শ্রী যুক্ত করে দিয়েছেন। তারা চমৎকারিতা-এর সমার্থক শব্দ হিসেবে রমণীয়তা ও সৌকুমার্য চয়ন করার পক্ষপাতী। সবুজ তাপস সৌন্দর্য সম্পর্কে বলেছেন, এটি লৈঙ্গিক ব্যাপার নয়। বক্তব্যের সমর্থনে অবশ্য তিনি ময়ুখ চৌধুরীর একটি কবিতা তুলে ধরে দেখিয়েছেন, কবিতার ক্ষেত্রে রমণীয়তা ও সৌকুমার্য নয়, মনেআহারিতার ব্যাপারই জাজ্জ্বল্যমান-


মেঘের মাগী জল দিলো নাছিনাল নদী মাছ দিলো নাদিন গেছিল মাস গেছিল ঘুম গেছিল চোখ থেকেনখের সাদা ফুল গেছিল নখ থেকে

 
সবুজ তাপস বলেছেন, সৌন্দর্য কেবল অন্তরিন্দ্রিয়গত নয়, চক্ষুরিন্দ্রিয়গত বিশিষ্টপুলকজনক বোধও । একটু আগ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কথা উল্লেখ করা হলো। চোখ ও কান- দুটো জ্ঞানেন্দ্রিয়। কবিতার সৌন্দর্য (রূপ, চাকচিক্য ইত্যাদি)দর্শন/উপভোগের সময় চক্ষুরিন্দ্রিয়ের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার জো নেই। চোখ দেখে এবং দর্শিত বস্তুর ছায়াবার্তা পাঠায়। এরপরই চলতে থাকে আমাদের আনন্দলাভ অভিযান। বক্তব্যের সমর্থনে তিনি তুলে ধরেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা-


খানাখন্দ ভেতরে না হোকআছেতাইতো তারই কাছেঝুড়িভর্তি পাথর আনতে ছুটিসেইসঙ্গে একমুঠিঅন্নকৃপা করো - সবার জন্যকিছু না থাকে শ্মশানের দরজাটাই খোলাধানের গোলাচাইদিগন্তে বাজখাঁই
চাঁদের আলোভালো-না বাসার অর্থ- কাঠিন্যসবার জন্যশ্মশানের দরজাটাই খোলাধানের গোলাচাইদিগন্তে বাজখাঁইচাঁদের আলোভালোওইটুকুর জন্যই বেঁচে আছি


শক্তির কবিতাটির সৌন্দর্য চোখ ও মনের সক্রিয়তার মাধ্যমেই উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে। চোখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে কবিতাটির স্ট্রাকচার বা গঠন। এ-গঠন চোখের মাধ্যমেই মনের দপ্তরে পৌঁছছে এবঙ মনস্থ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কবিতাটি যে-পৃষ্ঠায় রয়েছে, তার মুখ্যগুণও (Primary Quality) গঠনের পাশাপাশি মনস্থ হচ্ছে। মনের মধ্যে পৃষ্ঠার এ-যে মুদ্রণ (Impression) তাও চোখের ভূমিকার স্বীকৃতি দিচ্ছে। একটু আগে কানের কথা বলা হলো, বোধ না করতে পারলেও কোনোকোনো কবিতা শুনেও আমরা আনন্দিত হতে পারি। কান দিয়ে আমরা কবিতার কথা, ছন্দোগতি শুনি; যা মনের মধ্যে পুলকজাগায়। উপরে তুলে ধরা ময়ুখ চোধুরীর কবিতাটি শুনলে যে কোনো কাব্যরসিক জন্মান্ধও আনন্দিত হবেন।
সবুজ তাপস কবিতার সৌন্দর্য উপভোগের বেলায় সৌন্দর্য-এর নিম্নোক্ত শব্দস্রোতকে স্বীকৃতি দিয়েছেন-
সৌন্দর্য- শোভা, লালিত্য, মনোহারিতা, রূপশোভা- কান্তি, মাধুরী, সৌষ্ঠব, বাহারলালিত্য- শ্রী, শোভা, কান্তিমনোহারিতা- চিত্তাকর্ষণকারিতারূপ- শোভাকান্তি- লাবণ্যমাধুরী- মাধুর্য (মধুরতা)সৌষ্ঠব- উৎকর্ষবাহার- শোভাশ্রী- লাবণ্য, শোভা, রূপ, ঢঙলাবণ্য- চাকচিক্য, কান্তি, শ্রী, শোভা, লাবণিচাকচিক্য- ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি, পালিশলাবণি- লাবণ্য, লালিত্য, মাধুর্য, কান্তিউৎকর্য- শ্রেষ্ঠত্বঔজ্জ্বল্য- দীপ্তি, চেকনাইশ্রেষ্ঠত্ব- উৎকৃষ্টতা,চেকনাই- ঔজ্জ্বল্য, চাকচিক্য, মসৃণতা, লাবণ্যমসৃণতা- স্নিগ্ধতা, কোমলতাস্নিগ্ধতা- কোমলতা, মধুরতাকোমলতা- লালিত্য, মাধুর্য।দৃষ্টান্তবাদ অনুসারে, শব্দ হলো কবিতার দেহের ক্ষুদ্রাংশ। শব্দ ছাড়া কবিতা হতেই পারে না এবং এর কারণেই কবিতা বাঙ্ময় ও বাণীযোগ্য। শব্দকে হতে হয় অলংকৃত, এই জন্যে যে, এছাড়া এর সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায় না। তাছাড়া সৌন্দর্যসাধক বলে অলংকৃত শব্দ/ শব্দবন্ধ রচনা করতে পারার মধ্যেই নিহিত থাকে কবির কবিত্ব। অলংকরণ ছাড়া সুন্দর শব্দবন্ধ এবং সুন্দর শব্দবন্ধ তৈরির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হোয়া ছাড়া কে পারে সুন্দর শিল্প রচনা করতে? সবুজ তাপস বলেছেন, অলংকার সৌন্দর্যবর্ধনকারী একপ্রকার বস্তু বটে, তবে এটি কবিতার দেহের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জুড়ে থাকা, খাপখাইয়ে থাকা। কবি এটি সাধারণ অর্থের অতিরিক্ত এক চমৎকারিত্ব হাজির করার জন্যই মূলত ব্যবহার করেন। এই যে বক্তব্য, এটি সপ্তম শতাব্দির দেহবাদী আলংকারিক দন্তী এবং অষ্টম শতাব্দির আলংকারিক বামনের মতের সাথে সাযুজ্য রেখে দেয়া হয়েছে। দন্তী বলেছেন, যে সকল ধর্ম কাব্যের শোভা জন্মায়, সেগুলোই অলংকার ( কাব্যশোভাকরান ধর্মান্ অলংকারান্ প্রচক্ষ্যতে)। অর্থাৎ তাঁর মতে, অলংকৃত শব্দই কাব্যের শোভা বা সৌন্দর্য। আলম থেকে অলংকার ব্যুৎপন্ন বলে শব্দকে নানা প্রকার ভূষণে সজ্জিত করার নামই অলংকার। বামনের মতে, অলংকারের কারণেই কাব্য গ্রহণযোগ্য (কাব্যম গ্রাহ্যম অলংকারাৎ )।অর্থাৎ তাঁর মতে, অলংকারই সৌন্দর্য। কিন্তু তাদের বক্তব্যের সাথে সবুজ তাপসর বক্তব্যের তফাৎ রয়েছে। তিনি বলেছেন, শব্দ কেবল অলংকৃত হলে নয়, অলংকৃত শব্দের তর্কশাস্ত্রসম্মত-বাস্তব রূপ থাকলে এবং এভাবে নির্মিত বাক্যের সহযোগে যে কবিতা রচিত হবে, তাকেই বলা যাবে দৃষ্টান্তবাদসমর্থিত। এইজায়গায় তিনি উদাহরণ হিসেবে মংসিংঞো-এর একটি কবিতা তুলে ধরেছেন-


কৌম জীবনের প্রচলিত প্রাচীন প্রবাদকোমল কুমারী কর্ণফুলীর দুঃখিত-দর্পণে ভাসেপৌরাণিক প্রতারণা নিয়ে এক কুরূপ কাহিনী….নিরবে নিমগ্ন হলে আদি আবাসের জমিজ্বলে ওঠে অনন্ত আমার ক্রুর পটভূমি!

 
সবুজ তাপস দেহবাদীদের সাথে কিছু ক্ষেত্রে সহমত পোষণ করলেও আত্মাবাদী তথা রসবাদীদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। আত্মাবাদীদের বক্তব্য অনুসারে, শব্দ, বাচ্য, রীতি, অলংকার, ছন্দ ইত্যাদি একত্র হয়ে কাব্যের রস সৃষ্টি করে না, রসই নিজেকে মূর্ত করে তোলার আবেগে এসব সৃষ্টি করে। এবং তারা এও বলেছেন, দেহের নানা অঙ্গপ্রতঙ্গের মিলনে প্রাণের সৃষ্টি হয়নি, বরং প্রাণই এ-অঙ্গপ্রতঙ্গের স্রষ্টা। অর্থাৎ শব্দ, বাচ্য, রীতি, অলংকার, ছন্দ ইত্যাদির সাহায্যে ছাড়া রস নিজেকে মূর্ত করতে পারে না। সবুজ তাপস মনে করেন, রস কখনো মূর্ত হওয়া বিষয় নয়। রস যেহেতু অব্যক্ত এবং অনির্দিষ্ট, সেহেতু এটি সবসময় অমূর্তই থেকে যাবে। তারা এও বলেন, জগৎ হলো ব্রহ্মময়, জগতের চেতন-অচেতন সবকিছুই ব্রহ্মের অঙ্গ। দৃষ্টান্তবাদ ব্রহ্মসংশ্লিষ্ট তাদের এ-আলোচনার জন্যই মূলত রসধারনাকে গ্রহণ করে না। এ-মতানুসারে, অলৌকিক মায়ার জগৎ নয়, কাব্যের জগৎ হলো অনির্বচনীয় আনন্দজগৎ। 

http://www.facebook.com/update_security_info.php?wizard=1#!/note.php?note_id=152220438144913